ভারতীয় সংবিধানের বৈশিষ্ট্য

ভারতীয় সংবিধানকে "Bag of Borrowings" অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে কারন ভারতীয় সংবিধান বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য সংগ্রহ করে রচনা করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ভারতীয় সংবিধানের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য আছে যা তাকে অন্যান্য দেশের সংবিধান থেকে আলাদা করেছে। সুবিখ্যাত সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসুর মতে — আপন বিশিষ্টতার জন্যই ভারতীয় সংবিধান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংবিধানের থেকে স্বতন্ত্র (‘ The Constitution of India is remarkable for many outstanding features which will distinguish it from other Constitutions … ’) । এই রকমই কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল-

১) বিশ্বের বৃহৎ লিখিত সংবিধান :-ভারতীয় সংবিধানকে সারাবিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ লিখিত সংবিধান বলে আখ্যা দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি যখন ভারতীয় সংবিধান কার্যকর হয় - সে সময় ৩৯৫ টি ধারা এবং ৮ টি তপশিল নিয়ে ভারতীয় সংবিধান রচিত হয়েছিল ; বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনের পর বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানের সর্বমোট ধারা প্রায় ৪৫০ এবং তফসিলের সংখ্যা ১২ দাঁড়িয়েছে।

২) সংবিধানের প্রস্তাবনা :-ভারতীয় সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের অনুকরণে ভারতীয় সংবিধানের সঙ্গে একটি প্রস্তাবনার সংযুক্তি। এই প্রস্তাবনার দ্বারা সংবিধান প্রণেতাগণ এর উৎস , উদ্দেশ্য এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামাে বর্ণনা করেছেন ।

৩) সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধানের মিশ্রন :-ভারতের সংবিধান একইসঙ্গে সুপরিবর্তনীয় ও দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির। নতুন রাজ্যের সৃষ্টি, পুরাতন রাজ্যের সীমানা বা নাম পরিবর্তন, বিধান পরিষদের সৃষ্টি অথবা বিলোপ প্রভৃতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের জন্য পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের সাধারণতসংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনে সংবিধান সংশোধন হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, কেন্দ্র-রাজ্য ক্ষমতা বণ্টন,সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়গুলিকে সংশোধন করতে হলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সমর্থন ছাড়াও রাজ্যগুলির অন্তত অর্ধেকের সমর্থন প্রয়োজন।

৪) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা :-ভারতীয় সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং অনেকগুলি রাজ্য সরকারের মধ্যে শাসন ক্ষমতা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে শাসন ক্ষমতা তিনটি তালিকায় বন্টিত হয়েছে। এই তালিকা তিনটি হল যথাক্রমে - কেন্দ্রীয় তালিকা ,রাজ্য তালিকা ও যুগ্ম তালিকা। কেন্দ্রীয় তালিকায় ৯৭ টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত ;রাজ্য তালিকায় ৬৩ টি বিষয় রাজ্য সরকারের হাতে এবং যুগ্ম তালিকায় ৫২ টি বিষয় যুগ্মভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। উপরোক্ত তিনটি তালিকার বাইরে যে সকল অবশিষ্ট ক্ষমতা রয়েছে সেগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

৫) সংসদীয় শাসনব্যবস্থা :-ভারতীয় সংবিধানে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে ব্রিটিশ সংবিধানের অনুকরণে। এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সর্বময় কর্তৃত্ব তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপতির হাতে থাকলেও কার্যত যাবতীয় ক্ষমতার অধিকারী হল সংসদ বা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা। ভারতের অঙ্গরাজ্য গুলিতেও সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।

৬) রাষ্ট্রপরিচালনার নির্দেশাত্মক নীতি সমূহ :-আয়ারল্যান্ডের সংবিধানের অনুকরণে রাষ্ট্রপরিচালনার নির্দেশমূলক নীতি গুলি ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ের ৩৬ থেকে ৫১ ধারার মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এই নীতিগুলি নাগরিকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এবং জনকল্যাণকর সমাজ গঠনের পক্ষে অপরিহার্য।

৭) মৌলিক অধিকার:-ভারতীয় সংবিধানের ১২ থেকে ৩৫ নম্বর ধারায় ৬ প্রকার মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো - সাম্যের অধিকার ,স্বাধীনতার অধিকার ,শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার ,ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ,সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার এবং শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার।

৮) মৌলিক কর্তব্য :- ১৯৭৬ সালে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিকদের দশটি মৌলিক কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। যদিও এই কর্তব্য সমূহ আদালতের দ্বার বলবৎ করা যায় না, কিন্তু নাগরিকদের মধ্যে ঐক্য ও স্বদেশপ্রীতির মনোভাব জাগ্রত করার জন্য এগুলির একটি বিশেষ মনস্তাত্বিক তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমানে মৌলিক কর্তব্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১তে।

৯) এক নাগরিকত্ব :- ভারতীয় সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো গ্রহণ করা হলেও দ্বি- নাগরিকত্বের স্বীকৃত হয়নি। এখানে কোন অঙ্গ রাজ্যের আলাদা নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষমতা নেই। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল , রাজধানী অঞ্চল বা রাজ্যগুলির যেকোনো জায়গায় নাগরিকরা বসবাস করুন না কেন তারা সবাই একমাত্র ভারতীয় নাগরিক রূপে স্বীকৃত হবেন।

১০) সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার :- জাতি-ধর্ম-বর্ণ স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে আঠারো বছর বয়স্ক প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের ভোটদানের অধিকারকে রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

১১) স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ :- ভারতীয় সংবিধানের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতি। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের জন্য সংবিধানে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সেগুলি হল - বিচার বিভাগের রায় নিয়ে কোন প্রশ্ন পার্লামেন্টে বা অন্য কোথাও তোলা যায় না , বিচারপতিদের গুরুতর কারণ ছাড়া পদচ্যুত করা যায়না, বিচারপতিদের কার্যকাল ও সুযোগ-সুবিধার উল্লেখ - ইত্যাদি।

১২) ধর্মনিরপেক্ষতা :- সংবিধানে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ধর্মের বিষয়ে ভারত রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। রাষ্ট্র কখনোই সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করবেনা। ভারতে সব ধর্মের মর্যাদা সমান এবং রাষ্ট্রের কোন ধর্ম নেই।

১৩) সার্বভৌম ,গণতান্ত্রিক ,সাধারণতন্ত্র :-সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি সার্বভৌম ,গণতান্ত্রিক ,সাধারণতন্ত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সার্বভৌম কথাটির অর্থ হলো ভারত অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় দিক থেকে চূড়ান্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। জনগণ নিজেরাই ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করে পরোক্ষভাবে সরকার গঠনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

১৪) বিশেষ সংরক্ষণ ব্যবস্থা :- ভারতীয় সংবিধানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অনুন্নত শ্রেণীর উন্নতি বিধানের জন্য কয়েকটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন কেন্দ্র ও রাজ্য আইনসভা গুলিতে আসন সংরক্ষণ , সরকারি চাকরিতে পদ সংরক্ষণ , শিক্ষার জন্য বিশেষ আর্থিক সাহায্য , তপশিলি জাতি - উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি।

১৫) জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিশেষ ব্যবস্থা :- সংকটকালীন অবস্থা মোকাবিলার জন্য ভারতীয় সংবিধানের ৩৫২ থেকে ৩৬০ ধারাতে জরুরী অবস্থা সংক্রান্ত বিশেষ ব্যবস্থা সন্নিবেশিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৩৫২, ৩৫৬ এবং ৩৬০ নং ধরা অনুসারে যথাক্রমে জাতীয় জরুরী অবস্থা, রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জনিত জরুরী অবস্থা এবং আর্থিক জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন।